পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল অত্যন্ত বৈচিত্রপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গ পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য।
দক্ষিণে ২১º৩৮' উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ২৭º১০' উত্তর অক্ষাংশ এবং
পশ্চিমে ৮৫º৫০' পূর্ব দ্রাঘিমা হেকে পূর্বে ৮৯º৫০' পূর্ব দ্রাঘিমা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি বিস্তৃত। এ-রাজ্যের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর, ধুবুলিয়া, বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী, গুসকরা, আউসগ্রাম, রাজবাঁধ, দুর্গাপুর, বাঁকুড়া জেলার দুর্লভপুর এবং পুরুলিয়া জেলার আদ্রা শহরের উপর দিয়ে পূর্বপশ্চিমে কর্কটক্রান্তি রেখা প্রসারিত। এ-রাজ্যের উত্তর সীমা যেমন হিমালয় পর্বতমালাকে স্পর্শ করেছে, তেমনি দক্ষিণসীমায় রয়েছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সুবিশাল বদ্বীপ ও বঙ্গোপসাগর। তিনটি বিদেশি রাষ্ট্র – নেপাল, ভূটান ও বাংলাদেশ এবং পাঁচটি ভারতীয় রাজ্য – সিক্কিম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও অসম প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী। এছাড়াও সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সান্নিধ্যের জন্য ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বিদ্যমান।
রাজ্যের উত্তরে রয়েছে হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ, আবার দক্ষিণে রয়েছে সমুদ্র-উপকূলীয় সমভূমি; পশ্চিম দিকে যেমন রয়েছে মালভূমি অঞ্চল, তেমনি পূর্বদিকে রয়েছে গাঙ্গেয় বদ্বীপ
সমভূমি। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একমাত্র রাজ্য যার উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে
সমুদ্র রয়েছে। এই রাজ্যে মালভূমি ও সমভূমির সহাবস্থান দেখা যায়।
অবস্থান ও বিস্তৃতি
পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের
পূর্বদিকে অবস্থিত। এ-রাজ্যের উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয়ের কোলে অবস্থিত
নেপাল ও ভূটান রাষ্ট্র এবং সিক্কিম রাজ্য; পূর্বদিকে অসম রাজ্য ও বাংলাদেশ
রাষ্ট্র, পশ্চিমে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
পশ্চিমবঙ্গের আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গ কিলোমিটার বা ৩৪,২৬৭ বর্গ মাইল।
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম মেট্রোপলিটান বা মহানগরীয় অঞ্চল এবং তৃতীয় বৃহত্তম শহর।
রাজনৈতিক ভূগোল
পশ্চিমবঙ্গে তিনটি রাজনৈতিক বিভাগ ও মোট ১৯টি জেলা রয়েছে। যেমন – বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি ও পুরুলিয়া; জলপাইগুড়ি বিভাগের অন্তর্গত উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও মালদহ এবং প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হাওড়া জেলা। প্রতিটি জেলা মহকুমাশাসক কর্তৃক শাসিত মহকুমা ও মহকুমাগুলি ব্লকে বিভক্ত থাকে। পঞ্চায়েত ও পুরসভা নামক স্থানীয় শাসনপ্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে ব্লক গঠিত হয়। এছাড়াও গঙ্গার উত্তরের ছয়টি জেলাকে একত্রে উত্তরবঙ্গ ও গঙ্গার দক্ষিণের জেলাগুলিকে একত্রে দক্ষিণবঙ্গ বলা হয়। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আরক্ষা (পুলিশ) বিভাগীয় আঞ্চলিক একক।
ভূমিরূপ
দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর দিকে হিমালয় পর্বতমালা অবস্থিত। রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে পূর্ব হিমালয় পর্বতমালার অন্তর্গত দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল অবস্থিত। সমগ্র দার্জিলিং জেলা (শিলিগুড়ি মহকুমা ছাড়া) ও জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর দিকের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত হয়েছে। এই অঞ্চল তরাই অঞ্চলের ঠিক উত্তর দিকে অবস্থিত। উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত তিস্তা নদীর গভীর উপত্যকা এই পার্বত্য অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করেছে: সিঙ্গালিলা ও দার্জিলিং পর্বতশ্রেণী। সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণী দার্জিলিং ও নেপালের সীমান্তে অবস্থিত। এই পর্বতশ্রেণীতে চারটি গুরুত্বপূর্ণ শৃঙ্গ রয়েছে – সান্দাকফু, ফালুট, সবরগ্রাম ও টংলু। সান্দাকফু (৩,৬৩৬ মিটার (১১,৯২৯ ফু)) পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। দার্জিলিং শহরের কাছে টাইগার হিল ও ঘুম
নামে দুটি শৃঙ্গ রয়েছে। টাইগার হিল থেকে বিভিন্ন পর্বতশ্রেণী বিভিন্ন
দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বভাগের দার্জিলিং পর্বতশ্রেণীর একটি গুরুত্বপূর্ণ
শৃঙ্গ হল দুরপিনদারা। হিমালয়ের পাদদেশে তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চলে কয়েকটি পাহাড় দেখা যায়। জলপাইগুড়ি জেলায় শিবালিক পর্বতশ্রেণীর কিছু খণ্ডাংশ রয়েছে। এর নাম বক্সা-জয়ন্তী পাহাড়।
তরাই অঞ্চল
তরাই (কথাটির অর্থ
আর্দ্র অঞ্চল) হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে
৩৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত জলাভূমিময় তৃণভূমি, সাভানা ও বনভূমির একটি
অঞ্চল। তরাই অঞ্চলের উত্তরে অবস্থিত হিমালয়ের পাথর, নুড়ি আর ক্ষয়প্রাপ্ত
মাটিতে তৈরি বনময় ভাবর
অঞ্চল। তরাই অঞ্চলের মাটিতে কাদা ও বালির পর্যায়ক্রমিক স্তর দেখা যায়।
এখানকার ভৌমজলপৃষ্ঠ (ওয়াটার টেবিল) উচ্চ হওয়ায় অনেক ঝোরা ও জলভূমি দেখা
যায়। তরাই অঞ্চলের নদীগুলিতে বর্ষাকালে দুকূল ছাপিয়ে বন্যা হয়।
তরাই-ডুয়ার্স সাভানা ও তৃণভূমি
একটি বাস্তু-অঞ্চল (ইকোরিজিয়ন)। এই অঞ্চলটি গোটা তরাই অঞ্চলের মধ্যভাগ
জুড়ে অবস্থিত। এইখানে লম্বা লম্বা ঘাসের তৃণভূমি, সাভানা এবং চিরহরিৎ ও
পর্ণমোচী বনভূমি দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার সমভূমি অঞ্চল (শিলিগুড়ি মহকুমা), গোটা জলপাইগুড়ি জেলা এবং কোচবিহার জেলার
উত্তরাঞ্চল নিয়ে তরাই অঞ্চল গঠিত। এখানকার ভূমির ঢাল উত্তর থেকে দক্ষিণ
দিকে, এবং এই ঢালও বেশি নয়। ভূমিভাগের সাধারণ উচ্চতা ৮০-১০০ মিটার। তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা, সঙ্কোশ প্রভৃতি বড় এবং একাধিক ছোট নদীর বয়ে আনা বালি, নুড়ি ও পাথরে গড়ে উঠেছে তরাই।
উত্তরবঙ্গ সমভূমি
তরাই অঞ্চলের দক্ষিণ থেকে গঙ্গার বাম তীর পর্যন্ত অঞ্চল উত্তরবঙ্গ সমভূমি নামে পরিচিত। জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাঞ্চল, উত্তর দিনাজপুর জেলা (উত্তরের কয়েকটি অংশ বাদে), দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, মালদহ জেলা ও কোচবিহার জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে এই সমভূমি গঠিত। উত্তর দিনাজপুরের যে সংকীর্ণ ভূখণ্ডটি মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুরের সঙ্গে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার সংযোগ রক্ষা করছে তার নাম মহানন্দা করিডোর। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের সমস্ত অঞ্চলই পলল সমভূমি।
মহানন্দা নদী মালদহ জেলাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। পূর্বাংশটি প্লাবন সমভূমি। এটি পুরনো পলিমাটিতে গঠিত। এখানে কয়েকটি টিলাও দেখা যায়। এই অঞ্চলটি বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত এবং এটি গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের অংশ। পশ্চিমাংশটি নতুন পলিমাটিতে গঠিত। এই অংশে কালিন্দী নদী মহানন্দা নদীতে মিশেছে। মালদহের কালিন্দী নদীর উত্তরে অবস্থিত ভূমিভাগ তাল নামে পরিচিত। এটি একটি নিম্নভূমি। এখানে অনেক জলা ও বিল দেখা যায়। কালিন্দী নদীর দক্ষিণে অবস্থিত উর্বর অংশটির নাম দিয়ারা।
জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার দক্ষিণাঞ্চলও নতুন পলিমাটি এবং তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা, সঙ্কোশ, বালাসোন, পুনর্ভবা, আত্রেয়ী ও অন্যান্য ছোট নদীগুলির জমা করা নুড়িপাথরে তৈরি হয়েছে।
রাঢ় অঞ্চল
দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি ও উচ্চভূমি অঞ্চল ও গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের মাঝের অংশটি রাঢ় নামে পরিচিত। মুর্শিদাবাদ জেলার অংশবিশেষ এবং গোটা বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নিয়ে রাঢ় গঠিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৫০-১০০ মিটার। মনে করা হয়, দাক্ষিণাত্য মালভূমি থেকে আনীত মাটিতে এই অঞ্চল গঠিত হয়েছে। ভাগীরথী-হুগলি নদীর উপনদী ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর ও রূপনারায়ণ নদ এই অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত। এখানকার মাটি ল্যাটেরাইট প্রকৃতির। তাই এই মাটির রং লাল। এখানকার জমির স্বাভাবিক ঢাল পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।
উপকূলীয় সমভূমি
পশ্চিমবঙ্গের একেবারে দক্ষিণে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলে একটি ছোট উপকূলীয় সমভূমি দেখা যায়। এই সমভূমি নদীপ্রবাহ ও বায়ুপ্রবাহের দ্বারা বাহিত বালি ও কাদায় গঠিত। উপকূল অঞ্চলের সমান্তরালে বালিয়াড়ি ও জলাভূমি দেখা যায়। দিঘা বালিয়াড়ি বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে কাছে এবং কাঁথি বালিয়াড়ি সবচেয়ে দূরে অবস্থিত। কোথাও কোথাও সমুদ্র থেকে বালিয়াড়িগুলির দূরত্ব ১৫-১৬ কিলোমিটার এবং উচ্চতা ১১-১২ মিটার।
উৎস-http://bn.wikipedia.org