জ্যোৎস্না আলোকিত রাতে সুসজ্জিত বাগানে একাকী বিষণ্ণ মনে বসে আছেন রাজকুমারী ঊষা। গতকাল রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেছেন, সাদা পক্ষীরাজ ঘোড়ায় করে এক অপরূপ রাজপুত্র তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তাকে প্রথম দেখেই প্রেমে পড়েছেন বাণ রাজার কন্যা। প্রেমে ব্যাকুল ঊষা পুনর্ভবার তীরে রাজ উদ্যানে বসে স্বপ্নে দেখা সেই সুদর্শন রাজপুত্রের কথাই ভাবছিলেন। এমন সময়ে তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল। সখী চিত্রাঙ্গদা এসেছেন। চিত্রাঙ্গদা জানালেন রাজদরবারে এক সুপুরুষ রাজপুত্র এসেছেন মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে। চিত্রাঙ্গদার বার্তা শুনে ঊষার দক্ষিণ বাহু কাঁপল। হঠাৎ বাম বাহু কাঁপায় শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন ও আশান্বিত ঊষা রাজদরবারে গেলেন। দূর থেকে যা দেখলেন, তাতে স্তম্ভিত তিনি—“এ তো সেই, যাকে আমি স্বপ্নে দেখেছি!” বাকরুদ্ধ হলেন রাজকন্যা। এর পরে সখী চিত্রাঙ্গদাকে নিজের মনের কথা জানালেন ঊষা।
অনিরুদ্ধ, দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণের নাতি। এসেছিলেন বাণরাজার সঙ্গে দেখা করতে, কৃষ্ণের দৌতকার্য করতে। অনিরুদ্ধের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ বাণরাজাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বাণরাজা যেন পাণ্ডবদের পক্ষ নিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু শিবের উপাসক বাণরাজা ছিলেন কৌরবদের পক্ষে। অনিরুদ্ধের প্রস্তাব পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে তাকে বিদায় করেন বাণরাজা। ফিরে যাবেন অনিরুদ্ধ। এমন সময় তার কক্ষে চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ। “রাজকুমারী ঊষা আপনার সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব। অনুগ্রহ করে আজ সন্ধায় তার প্রিয় বাগানে এক বার দেখা করে যাবেন।” চিত্রাঙ্গদার এমন আর্জিকে উপেক্ষা করতে পারেননি অনিরুদ্ধ। সে দিন যদি এই অনুরোধ উপেক্ষা করতেন অনিরুদ্ধ তাহলে ইতিহাস ও পুরাণের অনেক কাহিনীকে আজ নতুন রূপেপাওয়া যেত। যাই হোক, দ্বারকায় ফেরার আগে লাস্যময়ী চিত্রাঙ্গদার কাতর অনুরোধে সন্ধেয় পুনর্ভবার তীরে সুসজ্জিত বাগানে ঊষার সঙ্গে দেখা করতে যান অনিরুদ্ধ। গোলাপ, টিউলিপ, টগর ও নাম না জানা নানান রকমের ফুলে সুসজ্জিত, সুরোভিত বাগানের একপাশে কে ও, বসে আছেন? ঊষা মুখ ফেরাতেই হতবাগ অনিরুদ্ধ! আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা এখানে! অনিরুদ্ধ ও ঊষা দু’জনেই বাকরুদ্ধ। দু’জনেই নিজের নিজের স্বপ্নে দু’জনকে এত দিন দেখেছেন। আজ যখন বাস্তবিক সামনে দেখছেন কথা ফুরিয়ে গিয়েছে দুই প্রেমিকের। তার পর ওই রাতেই ঊষাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বারকার উদ্দেশে পালিয়ে যান অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধ ঊষাকে নিয়ে যখন মাঝ রাস্তায়, তখন খবর পান বাণরাজা। মাঝপথেই তাদের আটক করে নিজের রাজ্যে নিয়ে এসে অনিরুদ্ধকে কারাগারে বন্দি করেন বাণ। সংবাদ যায় দ্বারকায়। শ্রীকৃষ্ণ সৈন্য নিয়ে বাণ রাজ্য আক্রমণ করেন। নাতিকে উদ্ধার
করতে পুনর্ভবার তীরে কৃষ্ণের সঙ্গে বাণ রাজার তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে পরাজিত হয় বাণ। কারাগার থেকে মুক্ত হন অনিরুদ্ধ। বশ্যতা স্বীকার করে ঊষার সঙ্গে অনিরুদ্ধের বিয়ে দেন বাণ রাজা। এবং তারপর শৈব বাণ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সন্ধি করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষ অবলম্বন করার অঙ্গীকার করেন। পৌরাণিক এই ঘটনা দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর, তপন, কুশমণ্ডি ও হরিরামপুর ব্লকের নামকরণ ও নানা পৌরাণিক নিদর্শন বহন করে চলেছে।
কথিত আছে, যে রাস্তা দিয়ে অনিরুদ্ধ ঊষাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই রাস্তার নাম ঊষাহরণ, যা বর্তমানে কুশমণ্ডি ব্লকের প্রধান একটি রাস্তা। কুশমণ্ডি চৌমাথা থেকে মহিষবাথান হয়ে হরিরামপুর যাবার রাস্তাটিই ঊষাহরণের রাস্তা। আজও সেই রাস্তা নিজের নামকরণের মাধ্যমে ঊষাহরণের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। কথিত আছে, পুনর্ভবার তীরে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বাণরাজার যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্যের মৃত্যু হয়। এত মৃত সৈন্যের দাহ কার্য কী ভাবে হবে? অবশেষে কৃষ্ণ প্রস্তাব দেন, মৃত সৈন্যদের আঙুল কেটে সেই আঙুলের দাহ করে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হোক। কৃষ্ণের প্রস্তাবমতো লক্ষাধিক সৈন্যের আঙুল একজায়গায় স্তূপীকৃত করে পুড়িয়ে দাহ করা হয়। সেই জায়গা পরে করদহ নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে তপন ব্লকের করদহ, সেই মিথ বয়ে চলেছে।
তপন ব্লকের তপন দিঘি, হরিরামপুরের বৈরহাট্টার শমীবৃক্ষ, আলতাদিঘি, হাতিডুবা এইসব অঞ্চল এখনও মহাভারতের যুগের নানান কাহিনী নিয়ে বিরাজমান। পৌরাণিক এই বরেন্দ্রভূমির দিনাজপুরের সঙ্গে বাণ গড়ের ইতিহাস মিশে উত্তরবঙ্গের এই জেলাকে পুরাণ ও ইতিহাসের এক মেলবন্ধনে আবৃত করেছে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরেই পুরাণ ও ইতিহাসের এই আশ্চর্য মেলবন্ধন এখনও পর্যন্ত আবৃদ্ধিত হয়েছে। পুরাণে যে স্থানে বাণরাজার রাজদরবার ছিল সেখানেই বাণগড়ের অস্তিত্ব
প্রমাণ করেছে ইতিহাসবিদেরা। ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ খননকার্য করে প্রমাণ করেছে, গঙ্গারামপুরেই ছিল এক উন্নত নগর সভ্যতা। যা বাণগড়, পরবর্তীতে কোটিবর্ষ বা দেবকোট নামে পরিচিত হয়। এই জনপদটি ছিল সুসজ্জিত। ইট নির্মিত রাস্তা, নর্দমা, কূপ এই সব ধ্বংসাবেশ আজও তা প্রমাণ করে। গঙ্গারামপুর শহরের মধ্যে বাণগড়েই সেই ধ্বংসাবেশ দেখা যায়। সেখানে খনন কার্য করে যে নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তাতেই প্রমাণ মেলে যে এখানে এক উন্নত নগর সভ্যতা ছিল। ইতিহাসবিদেরা বলেন, পালযুগে এই দেবকোট ছিল উন্নত নগর সভ্যতা। এই দেবকোট মহাবিহারে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর লেখাপড়া করেছিলেন। সেই জ্ঞান তিনি পরে তিব্বতে ছড়িয়ে দেন। বাংলার মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার এই দেবকোট অধুনা গুঙ্গারামপুর থেকেই প্রথম প্রচলন হয়। তবে এই দেবকোট ১২১০ সালের আগে পর্যন্ত ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিচরণ ক্ষেত্র। তার পরেই এই এলাকায় আসেন ইখতিয়া উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়া খিলজি। তিনি এখানে প্রথম মুসলিম ধর্মের প্রসার ঘটান। তৈরি করেন প্রথম
মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র। গঙ্গারামপুরের অদূরেই রয়েছে ধলদিঘি ও কালদিঘি। কথিত আছে, বাণরাজার স্ত্রী সুড়ঙ্গপথে এসে ধলদিঘির শীতল জলে স্নান করতেন। পৌরাণিক সেই ঘটনার সঙ্গে পরবর্তীতে ইতিহাসের মেলবন্ধন ঘটে। সেই ধলদিঘি এখনও রয়েছে। সেই দিঘির পাড়েই পালযুগের অনুপম স্থাপত্য নিদর্শন মৌলানা আতা শাহের দরগা রয়েছে। অনেকে বলেন, এই আতা শাহের দরগা একাদশ দ্বাদশ শতকে ছিল বৌদ্ধবিহার বা দেবালয়। এই ধলদিঘির পাড়ে আতা শাহের দরগায় পীরের মেলার প্রাচীনত্ব বৈচিত্রে ভরপুর। উরস উৎসবের মাধ্যমে এই মেলার সূচনা করেছিলেন সৈয়দ করম আলি টাটশাহি পীর সাহেব। বাংলার ১২৬০ সালে সিপাহি বিদ্রোহের আগের বছর এই মেলার শুরু হয়। ভারতের রাজধানী তখন ছিল কলকাতা। গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ক্যানিং। প্রতিবছর মাঘ মাসের ২৫ তারিখে এই উরস উৎসব হয়। উৎসবে খাসির মাংসের পোলাও দিয়ে পীরের সিন্নি দেওয়া হয়। ওই দিনই সামনের হরি মন্দিরে বৈষ্ণব ভক্তরা এসে। | খোল করতাল বাজিয়ে পীর সাহেবকে শ্রদ্ধা জানান। ধলদিঘির ধারে এই উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে। বাংলার ইতিহাসে এই মেলা হিন্দু মুসলিমের এক অপূর্ব মেলবন্ধনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।
ইতিহাস ও পুরাণ কথায় সমৃদ্ধ বাণগড় আজ অবহেলায় উপেক্ষিত। চারিদিক উন্মুক্ত "বাণগড়ে এখন গুটি কয়েক ইটের স্তূপ ছাড়া কিছু নেই। ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ প্রথম ২০০৭ সালে এখানে খননকার্য চালায়। ২৬ দিন খনন কার্য করার পরে তামার তৈরি নানা যন্ত্রপাতি উদ্ধার হয়। তারপর খননকার্য বন্ধ হয়ে যায়। ফের ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত খননকার্য চালায় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ। এই খননকার্য থেকে যে সব ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তাতে স্পষ্ট এই বাণগড়ে তাম্রপ্রস্তর যুগ থেকে মৌর্য, গুপ্ত, পাল যুগ হয়ে মোগল আমল পর্যন্ত উন্নত জনপদ ছিল। এমন ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক সংমিশ্রিত স্থান অবহেলায় পড়ে রয়েছে। চারিদিক উন্মুক্ত বাণগড়ে বর্তমানে রয়েছে কিছু ঐতিহাসিক দুর্গের ভগ্নাবশেষ। তার চারপাশে চাষের জমি। বাণগড় যেমন অরক্ষিত, তেমনই তার অনতিদূরে থাকা ধলদিঘি, কালদিঘির অবস্থাওঁ অথৈবচ। ঊষাহরণের রাস্তায় নেই পিচের প্রলেপ। ভাঙা রাস্তায় পুরাণের সেই গন্ধ আজ উধাও। বৈরহাট্টার শমীবৃক্ষ, যার কোটরে (কথিত আছে) পাণ্ডবরা বনবাসকালে অস্ত্র লুকিয়ে রেখে বিরাট রাজার দরবারে ছদ্মবেশে ছিলেন, সেই শমীবৃক্ষ আজ শীর্ণকায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ডালপালা হারিয়ে মৃতপ্রায় শমীবৃক্ষের কাছেই বিরাট রাজার হাতিডুবার দিঘির জলও শুষ্কপ্রায়। দিনাজপুরের এমন ইতিহাসবিজড়িত বাণগড় এখন জেলাবাসীর বিস্মৃতির অন্তরালে। পুরাণ কথা মুখে মুখে ফিরলেও এখন তা ফিকে। আর ইতিহাস সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে।
লিখেছেন বিহার বিশ্বাস। সোর্স - আনন্দবাজার পত্রিকা।